পৃথিবীর বিখ্যাত ১০ টি রঙিন শহর
বিশ্বের সেরা ১০ টি রঙিন শহর
রঙিন শহর এই শব্দটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। রঙিন শহর বলতে এমন কোন শহরকে বোঝানো হয় যে শহরের বিল্ডিং, রাস্তাঘাট এবং দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের রঙ ব্যবহার করা হয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে শহরের সীমান্তে থাকা নৌকাগুলোও রং বেরঙের হয়। এই রং বেরঙের শহর গুলো এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন পর্যটকরা এসে এই রং বেরঙের শহরে ভিড় জমান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম অসংখ্য রঙিন শহর রয়েছে। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক পৃথিবীর এমনই কিছু বিখ্যাত রঙিন শহর সম্পর্কে।
১. বুরানো, ইতালি
বুরানো ইতালিতে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জ বা শহর। এই শহরটি মূলত ৪ টি দ্বীপ দ্বারা গঠিত। এই দ্বীপের সকল ঘরবাড়ি নানান রঙে সজ্জিত। এই শহরে বসবাসকারীরা মূলত মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। শীতকালে ঘন কুয়াশা থাকার কারনে পূর্বে জেলেদের জন্য এই শহরের বাড়িগুলোকে আলাদাভাবে চেনা খুব কষ্টকর হয়ে পড়তো। তাই নিজেদের বাড়িগুলোকে আলাদাভাবে চেনার জন্য জেলেরা তাদের বাড়িগুলোকে নানান রঙে সজ্জিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ধারনা করা হয় যে, এভাবেই বুরানোতে ঘরবাড়িগুলো নানান রঙে সজ্জিত করার প্রথা চালু হয়েছে। তবে বর্তমানে যদি কেউ এ শহরে নিজের বাড়ি রঙ করাতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এমনকি কোন বাড়িতে কোন রঙ করা হবে সেটিও সরকার কর্তৃক জানানো হয়। অপরূপ সুন্দর এই বুরানো শহরটি দেখার জন্য প্রতিবছর লাখ-লাখ পর্যটক ইতালিতে আসেন।
২. নীহ্যাভন, ডেনমার্ক
নীহ্যাভন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অবস্থিত একটি মনোমুগ্ধকর রঙিন শহর। নীহ্যাভন শহরের ঘরবাড়িগুলো ১৭শ শতকে তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে এ শহরের অধিকাংশ ঘরবাড়িগুলোকে বিভিন্ন খাবার হোটেল এবং ক্যাফে তে পরিনত করা হয়েছে। এ শহরে যতগুলো ঘরবাড়ি আছে তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে পুরনো বাড়িটি হল ৯ নম্বর বাড়ি। এই ৯ নম্বর বাড়িটি ১৬৮১ সালে তৈরি করা হয়েছিল এবং এই বাড়িটি আজও তার পূর্ববর্তী রূপেই রয়েছে। এছাড়া একসময় এই শহরের ৬৭ নম্বর বাড়িটিতে বিখ্যাত লেখক হান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন থাকতেন বলে জানা যায়। এই শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্যটি হল, জলপথের দুইপাশে অবস্থিত অসংখ্য রঙিন ঘরবাড়ি।
৩. শেফশাওয়ান, মরক্কো
শেফশাওয়ান হল মরক্কোর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট্ট রঙিন শহর। এই শহরটি রিফ পর্বতের ওপর অবস্থিত। জনপ্রিয় এই রঙিন শহরটি অন্য সব রঙিন শহরগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। কারন এই শহরের প্রতিটি ঘরবাড়ি নীল এবং সাদা বর্ণের। শুধুমাত্র ঘরবাড়িগুলোই নয়, এই শহরের রাস্তাগুলোও নীল এবং সাদা রঙ দিয়ে সজ্জিত। এই শহরটি সর্বপ্রথম ১৪৭১ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই শহরটিকে রঙিন শহরে পরিনত করার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এ শহরে বসবাস করা ইহুদি সম্প্রদায়ের। ইহুদিরা নীল রঙকে আকাশ এবং স্বর্গের প্রতীক মনে করে। এই আধ্যাত্মিক চেতনাকে ধরে রাখতে ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম ইহুদিরা এই শহরটিকে নীল রঙ করে। ইহুদিদের সেই ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে অক্ষুণ্ণ রাখতে এখনও তারা বাড়িঘরে নীল রঙ ব্যবহার করে। অপরূপ সুন্দর এই নীল রঙের ছোট্ট শহরটিতে বর্তমানে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। পাশাপাশি নিয়মিত পর্যটকদের ভ্রমনতো আছেই।
৪. যোধপুর, রাজস্থান, ভারত
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল যোধপুর। এই শহরটি নীল শহর বা The Blue City নামেই অধিক পরিচিত। কেননা যোধপুরের অধিকাংশ ঘরবাড়ি নীল রঙ দ্বারা সজ্জিত। ধারনা করা হয়, পূর্বে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা নিজেদের বাড়িগুলোকে অন্য সকলের বাড়ি থেকে আলাদা করার জন্য নিজেদের বাড়িগুলোকে নীল রঙ করা শুরু করে। পরবর্তীতে অন্যান্যরাও এই পদ্ধতি অনুসরন করে। এই নীল রঙের ঘরবাড়িগুলো যে শুধুমাত্র শহরটিকে সুন্দর করে তুলেছে তা নয়, এখানে বসবাস করা স্থানীয়দের মতে, এই নীল রঙ তাদের ঘরবাড়িকে ঠাণ্ডা রাখতে এবং মশাকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। যোধপুর শহরটি চারদিক থেকে মরুভূমি দ্বারা ঘিরে রয়েছে। তাই এই নীল রঙের ঘরবাড়িগুলো তাদের বেশ স্বস্তিতে থাকতে সাহায্য করে।
৫. বো–কেপ, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা
বো–কেপ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন এর সিগন্যাল পর্বতের কাছাকাছি অবস্থিত একটি রঙিন শহর। রঙিন ঝলমলে রঙের ঘরবাড়ির পাশাপাশি এই শহরটি পাথরের খোয়া বাঁধানো রাস্তাগুলোর কারনেও বিখ্যাত। এ শহরটির রঙিন শহরে পরিণত হওয়ার পেছনে একটি সমৃদ্ধশালী ইতিহাস রয়েছে। ১৬শ এবং ১৭শ শতকের দিকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওলন্দাজরা অনেক দাস ক্রয় করে এই শহরে নিয়ে আসা শুরু করে। আর এই ক্রীতদাসদের কেপ মালয় নামে আখ্যায়িত করা হতো। এরপর ১৭৬০ সালের দিকে এই শহরে অনেক বাড়ি তৈরি করা হয় এবং বাড়িগুলো ক্রীতদাসদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ক্রীতদাসরা এই বাড়িগুলো কিনে নেয় এবং তারা এই বাড়িগুলোকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তোলে। এই রঙ হল তাদের স্বাধীনতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। এই শহরের সবচেয়ে পুরনো বিল্ডিংটি হল এই শহরে অবস্থিত জাদুঘর যা বো কেপ মিউজিয়াম নামে পরিচিত।
৬. সেইন্ট জন’স, নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা
সেইন্ট জন’স কানাডার পূর্বদিকে অবস্থিত নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাবার্ডর প্রদেশের রাজধানী। অপরূপ সুন্দর এই রঙিন শহরটি ওয়াটার স্ট্রিট ও ডাকওয়ার্থ স্ট্রিট এর ধারের বাড়িগুলোর জন্য পর্যটকদের কাছে অধিক আকর্ষণীয়। সেইন্ট জন’স শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এসব রংবেরঙের বাড়ি গুলোর কারণে এই শহরের সম্পূর্ণ একটা অংশের নাম দেওয়া হয়েছে জেলিবীন রো। যদিও এই নামে সেইন্ট জন’স শহরে কোন রাস্তা নেই, তবুও এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা এই শহরের একটি নির্দিষ্ট অংশ বোঝাতে জেলিবীন রো নামটি ব্যবহার করে। ধারনা করা হয়, পূর্বে দূর সমুদ্র থেকে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা নিজেদের বাড়ি সহজেই চিহ্নিত করার জন্য তাদের বাড়িগুলোকে নানান রঙে রাঙিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই শহরের ব্যাপারে একটি অবাক করার মত তথ্য হল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানি জি মার্কনি যখন তার রেডিও দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের এপার-ওপারে যোগাযোগ করার জন্য পরীক্ষা করছিলেন তখন সর্বপ্রথম সিগনাল পাওয়া গিয়েছিল এই শহর থেকে।
৭. লংইয়ারবেন, সালবার্ড, নরওয়ে
লংইয়ারবেন পৃথিবীর সর্ব উত্তরে অবস্থিত একটি রঙিন শহর। তবে রঙিন শহর হলেও বছরের অধিকাংশ সময় এই শহরটিকে রঙিন দেখা যায় না। কারন উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত হওয়ায় এই শহরে প্রায় সারা বছর জুড়েই তুষার থাকে। ফলে এই শহরটি বছরের অধিকাংশ সময় জুড়েই বরফে ঢাকা থাকে। বেশিরভাগ সময় বরফাচ্ছন্ন থাকায় এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা স্নো-স্কুটার দিয়ে যাতায়াত করে। ১৯০৬ সালে একজন আমেরিকান নাগরিক লংইয়ারবেনের নামানুসারে এই শহরটির নাম ‘লংইয়ারবেন’ রাখা হয়। ছোট্ট এই শহরটিতে বর্তমানে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করে।
৮. সান্তোরিনি, গ্রীস
সান্তোরিনি গ্রীসে অবস্থিত একটি নৈসর্গিক দ্বীপ। সান্তোরিনিতে ১৫ টি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম রয়েছে। এই শহরটি এর নয়নাভিরাম ধবধবে সাদা ঘরবাড়ি এবং পাথরের খোয়া বাঁধানো সংকীর্ণ রাস্তার জন্য বিখ্যাত। ধারনা করা হয় যে, ১৯শ শতকের দিকে এই শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাড়িগুলোকে চুনকাম করতে শুরু করে। কারন অন্যসব রঙ করার চেয়ে চুনকাম করতে খরচ অনেক কম হয়। পরবর্তীতে এই শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে চুনকাম করার প্রবনতা বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে এই চুনকাম করা এখানকার বাসিন্দাদের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে ওঠে। যারা রঙিন শহর পছন্দ করেন তাদের জন্য এই শহরটি নিঃসন্দেহে একটি আদর্শ গন্তব্য।
৯. লা বোকা, বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনাতে অবস্থিত অন্যতম সুন্দর রঙিন শহর হল লা বোকা। এই শহরে রয়েছে উজ্জ্বল রঙে রাঙ্গানো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঘরবাড়ি। লা বোকা শহর জুড়ে রয়েছে অনেক শিল্পীর বসবাস। এই শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা প্রদর্শনীতে শহরের রঙিন ঘরবাড়ি গুলোকে প্রদর্শনীর ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া এ শহরের অন্যতম আকর্ষণ হল টাঙ্গ নাচ। লা বোকা শহরের প্রায় সব জায়গাতেই টাঙ্গ dancer দের দেখতে পাওয়া যায়। উজ্জ্বল রঙে রাঙ্গানো ছবির মত এই শহরটি পৃথিবীর সকল পর্যটকদের জন্য এক বিশেষ আকর্ষণ।
১০. উইলেমস্ট্যাড, কুরাসাও
উইলেমস্ট্যাড হল কুরাসাও দেশের রাজধানী। এটি একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শহর। এ শহরটির চারটি অংশ রয়েছে। এই শহরটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই শহরে অবস্থিত ঘরবাড়িগুলোর পাশাপাশি এ শহরের সরকারি ভবন সমূহ, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, বাণিজ্যিক ভবনগুলোও উজ্জ্বল রঙে সজ্জিত। এ শহরটির রঙিন শহরে পরিনত হওয়ার পেছনে একটি অদ্ভুত কারন রয়েছে। বলা হয় যে, নবম শতকের দিকে এ শহরের গভর্নর জেনারেল অ্যালবার্ট কিকার্ট প্রচণ্ড মাইগ্রেন এর ব্যথায় ভুগতে থাকেন। সেসময় তিনি বুঝতে পারেন যে, শহরে অবস্থিত ধবধবে সাদা বাড়িগুলোতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হওয়ার কারনে তার এই অসুবিধা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে তিনি আদেশ দেন যেন শহরের সবগুলো ঘরবাড়ি এবং দালান গুলোকে সাদা ব্যতীত অন্য যেকোনো উজ্জ্বল রঙে রাঙ্গিয়ে তোলা হয়। সেই থেকে এই শহরটি রঙিন শহর হওয়ার তকমা লাভ করে।
এই ছিল পৃথিবীর সব নয়নাভিরাম রঙিন শহরগুলোর ঐতিহ্যবাহী সব বিষয়। এই রঙিন শহরগুলোর মধ্যে যদি কোন শহর সম্পর্কে আপনি আগে থেকে জেনে থাকেন অথবা আপনার জানা কোন শহরটি আমাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি তা আমাদের অবশ্যই কমেন্ট করে জানান।আজকের বিষয়টি (সেরা ১০) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।