বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্য

 

বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্য

সেই আদ্দিকাল থেকেই কতোই না অবাক করা আশ্চর্য ও অদ্ভুদ সব বিষয় পৃথিবীতে রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ বিস্ময়কর এই বস্তুর তালিকা তৈরি করে চলেছে। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, আর্টেমিসের মন্দির, অলিম্পিয়ার গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি, আলেক্সান্দ্রিয়ার বাতিঘর, গ্রেট পিরামিড ইত্যাদি ঐতিহাসিক সপ্তম আশ্চর্যগুলোর কথা আমরা সবাই জানি। এই তালিকাগুলি প্রকাশ পেয়েছিল বহু প্রাচীন কালে। প্রচলিত রয়েছে যে, ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এবং জ্ঞানী ক্যালিম্যাকোস আলেক্সান্দ্রিয়া এই তালিকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এর যথাযথ প্রমান পাওয়া যায়নি। এরপর ২০০৭ সালে Seven Wonders এর নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষের ভোটের সাপেক্ষে এই নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২০০০ সালে প্রায় ২০০ টি মনুমেন্টকে নিয়ে ভোট গ্রহন শুরু হয় এবং ফলাফল জানানো হয় ৭ই জুলাই ২০০৭ সালে লিসবনে।

তালিকায় নাম নেই আইফেল টাওয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি  সিডনী অপেরা হাউস, গিজা প্রভৃতি। এমনকি মিশরের গিজা, পৃথিবীর একমাত্র আসল বিস্ময়টিকেও অন্যান্য দর্শনিয় স্থান যেমন, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, সিডনী অপেরা হাউস প্রভৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতার সন্মুখীন হবার ঘটনায় অনেকই অসন্তুষ্ট হয় এবং এই প্রকল্পটিকে হাস্যকর বলে। এই সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে, গিজাকে সান্মানিক প্রতিযোগির আখ্যা দেওয়া হয়।

চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক এই নতুন তালিকাতে বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্যের (Seven Wonders) মধ্যে কি কি স্থান পেয়েছে তার বিস্তারিত।

১। চীনের মহাপ্রাচীর (চীন)

চীনের মহাপ্রাচীর বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ২২০ কিন শি হুয়াং এবং ১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ মিং রাজবংশি এই মহা প্রাচীরের স্থাপনার ক্ষেত্রে মহান কৃতিত্ব স্থাপন করেছিলেন।চিনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে সংযুক্ত করে একক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আনা এবং মোঙ্গল উপজাতিগুলির আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখে তাদেরকে চিন থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে। এর দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কি.মি.। এটি মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে বড় প্রাচীর। এই প্রাচীর মঙঙ্গলদের হাত থেকে বাচঁতে তৈরি হলেও তাতে খুব একটা সফল ছিলো না তারা, তবে একটি বিতর্কিত মত হল যে, এটি পৃথিবীর একমাত্র বস্তু, যা মহাকাশ থেকে দেখা যায়।

২। পেত্রা (জর্ডান)

প্রাচীন আরব নগরী পেত্রা বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সম্পূর্ণ এই নগরীটি মূলত পাথরের। নবাটায়েন সাম্রাজ্যের রাজা চতুর্থ আরেটাসের রাজধানী ছিল পেত্রা। আরব মরুভূমির ধারে অবস্থিত এই স্থানকে ১৯৪৫ সালে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি একধরনের নাট্যশালা। জল বহন ও সংরক্ষণ প্রযুক্তিতে পারদর্শী নবাটাইনরা তাদের শহরে বড় বড় সুড়ঙ্গ ও জলধারক কুঠুরি নির্মাণ করেছিল। গ্রীক-রোমান শৈলির অনুকরণে তৈরী এই নাট্যশালা। একটি নাট্যশালায় ৪০০০ দর্শকের বসার ব্যবস্থা ছিল। এখানে পাথর খোদাই করা অবিশ্বাস্য মূর্তি, একটি ৪,০০০ আসনের অ্যামফিথিয়েটার এবং এল-দেইর আশ্রমের উপরে অবস্থিত ৪২ মিটার উঁচু হেলেনীয় মন্দিরদ্বার রয়েছে। যেগুলি আজও মধ্য-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট নিদর্শন করে।

পেত্রা এক সময় সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ছিল নগরী ছিল।পরবর্তিতে রোমান শাসনের সময় রোমানরা সমুদ্র কেন্দ্রিক বাণিজ্য শুরু করলে পেত্রাদের আধিপত্য কমে যায় একইসাথে অর্থনৈতিক ভাবে পেত্রারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে শহরটির কিছুটা উন্নতি সাধন করা হলেও, পরবর্তীতে পেত্রার প্রতিদ্বন্দ্বী শহর পামিরা পেত্রাদের অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে ফেললে পেত্রার গুরুত্ব একেবারেই কমে যায়।

আরো জানুন: জানা অজানা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য

৩। দ্য রোমান কলোসিয়াম (ইতালি

রোমের সবচেয়ে স্থায়ী এবং ঐতিহ্যশালী পুরাতন নির্দশন হল কলোসিয়াম যা বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্যের অংশ।। ৭০ থেকে ৮০ খ্রিষ্টাব্দে এটি তৈরী করার উদ্দেশ্য ছিলো, বিজয়ী রোমান সৈন্যদের পুরস্কৃত করার জন্য এবং রোম সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা তুলে ধরার জন্য। চক্রাকার কাঠামোতে প্রায় ৫০,০০০ দর্শক অবস্থান করতে পারেন। আজ ২০০০ বছর পরেও ওই কলোসিয়ামের অতুলনীয় নকশার ছাপ আধুনিক যুগের প্রায় প্রতিটি ক্রীড়াঙ্গনেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেইসময়ের দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য পশু শিকার, মৃত্যুদন্ড কার্যকর,যুদ্ধের প্রস্তুতি সহ আরও অনেক কিছু সরাসরি দেখানো হত। বলা হয় ৯ হাজার জীবন্ত প্রানী মারা গেছে এই কলোসিয়ামে


 চিচেন ইত্জা (মেক্সিকো)

মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির শহর হল চিচেন ইত্জা। এই শহরটি মায়া সভ্যতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্র ছিল। মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে অবস্থিত মায়ান সভ্যতার পুরাতন ধ্বংসাবশেষ এই স্থানকে বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্য হিসেবে স্বীকৃতি দাওয়া হয়েছে।। প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের, তাদের জীবনযাত্রার নমুনা যেমন পোশাক, মধু, ক্রীতদাসদের নমুনা এখান থেকে এখনো মেলে থাকে। এখানকার বিখ্যাত দর্শনিয় স্থানগুলি হল কুকুলকান পিরামিড, চাক মুলের মন্দির, হাজার স্তম্ভ বিশিষ্ট সভাগৃহ এবং কয়েদিদের খেলার মাঠ। এক হাজার বছর আগের এই পিরামিড মায়ান সভ্যতার অন্যতম নিরদর্শন। এই পিরামিডটি মায়া মন্দিরগুলির মধ্যে সর্বশেষ এবং অনেকের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ।

 মাচু পিছু (পেরু)

মাচু পিছু কথার অর্থ পুরনো পাহাড়। পঞ্চদশ শতকে ইনকা সম্রাট পাকাশুটেক পাহাড়ে মেঘের মধ্যে এক শহর নির্মাণ করেন যার নাম দেওয়া হয় মাচু পিছু। মাচু পিছু প্রাচীন ইনকাদের একটি শহর। এটিকে ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহরও বলা হয়। আমাজানের তীরে এই হারিয়ে যাওয়া শহরকে বিশ্বের সবচেয়ে রহস্য জনক এলাকা হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রচলিত রয়েছে, গুটিবসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ায় ইনকারা এই জায়গা পরিত্যাগ করে এবং স্পেনীয়রা ইনকা সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার পর প্রায় তিনটি শতক এই শহরটি মনুষ্য সভ্যতার থেকে হারিয়ে যায়। এটি আন্দিজ পর্বতের নিকট, আমাজ়নের গভীর জঙ্গলে এবং উরুবম্বা নদীর ওপরে অবস্থিত। এটি ১৯১১ সালের আগে পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে অপরিচিত ছিল। ১৯১১ সালে এক মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ Hiram Bingham একে নতুন করে আবিস্কার করেছিলেন। এরপর এটিকে বিশ্ববাসীর কাছে ছবি একে তুলে ধরেন।

আরো জানুন: আমাজন জঙ্গল সম্পর্কে অদ্ভুত ১৫টি তথ্য

 তাজমহল (ভারত)

পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহ্‌জাহান ১৬৩২ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত এটি নির্মাণ করে থাকেন। আগ্রার তাজমহল-মোঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তারই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এই বিশাল স্মৃতিসোধটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৪৮ সালে। এটি তৈরিতে সময় নেয় ১৬ বছর। বছরে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ তাজমহল দেখতে আসে। এই তাজমহল এখন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বিপুল ভোট পেয়ে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে সবার প্রিয় এই তাজমহল।


 ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার মূর্তি (ব্রাজিল)

যিশুর এই মূর্তিটি প্রায় ৩৮ মিটার উঁচু এবং রিও ডি জেনেইরোর সামনে করকোভাদো পাহাড়ের মাথায় স্থাপিত হয়েছে। রিও সিটির প্রতীক এই যীশুর মূর্তি। ১৩০ ফুট উঁচু এই মূর্তিটি হাইটর দ্য সিলভা কোস্টা নামের এক ব্রাজ়িলীয়ের করা নকশা অনু্যায়ী ফরাসি শিল্পী পল ল্যান্ডোওস্কি এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৩১ সালে এটি তৈরি হয় এবং এর ওজন ১০০০ টন। এটি তৈরিতে প্রায় ২৫০০০০ ডলার ব্যয় করা হয়েছে এবং সময় লেগেছিল প্রায় ৫ বছর। এর শুভ উদ্বোধন করা হয় ১৯৩১ সালের ১২ অক্টোবর।

সম্মানিত অবস্থা

মিশরের কায়রোতে অবস্থিত গিজার মহা পিরামিড কে তালিকায় সম্মানসূচক ভাবে (প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রাচীনকাল বলতে মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম সভ্য যুগ থেকে পশ্চিম রোমীয় সাম্রাজ্যের পতন অর্থাৎ মোটামুটি ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বলা হয়। পিরামিড বলতে আসলে একটা পিরামিড বোঝায় না, মিশরে এরকম বহু বহু পিরামিড আছে। কিন্তু গ্রেট পিরামিড বা মহা পিরামিড বলতে সম্রাট ফারাও পিরামিডকে বোঝানো হয়, এবং এটি অন্যান্য পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রাচীণ সপ্তাশ্চর্যের মাঝে সবচেয়ে প্রাচীণ এই স্থাপনাটিই এখনো অক্ষত অবস্থায় সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিশরের এল গিজা তে।

আজকের বিষয়টি (নতুন সপ্তম আশ্চর্য) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।